23.8 C
Los Angeles
সোমবার, ডিসেম্বর ৪, ২০২৩

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন-২০২৪

ক্লাস না করিয়ে পাঁচ বছর ধরে বেতন তুলছেন প্রাথমিক শিক্ষিকা

শিক্ষাক্লাস না করিয়ে পাঁচ বছর ধরে বেতন তুলছেন প্রাথমিক শিক্ষিকা
খবরটি শেয়ার করুন

পাঁচ বছর চাকরিকালীন নয় মাসও বিদ্যালয়ে যাননি। মেডিকেল ছুটির নামে বছরের পর বছর ধরে লাপাত্তা তিনি। বিদ্যালয়ে নিয়মিত না যাওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী তার নামও ভুলে গেছে। ঘটনাটি কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার চাঁনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। অভিযুক্ত শিক্ষিকার নাম মেহবুবা রায়না। তিনি অন্য একটি জেলায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্রীও। থাকেন সেখানেই।

রায়না ময়মনসিংহের ত্রিশালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের ওপর স্নাতক শেষ করে এখন স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে পড়ছেন। তিনি ২০১৬ সালে চাঁনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ দেন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ২০১৪-২০১৫ সেশনে।

এক সহকর্মী জানান, ২০১৬ সালে রায়না স্কুলে যোগ দিয়ে তিনমাস নিয়মিত ক্লাস নিয়েছেন। এরপর স্কুলে যাননি টানা তিন বছর। ২০২০ সালের মার্চে করোনা প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার আগে ছয় মাস মাঝেমধ্যে আসতেন। করোনা শুরু হলে অন্যান্য শিক্ষকরা স্কুলে এলেও তিনি আসেননি এক দিনের জন্যও।

স্কুলটির একজন সহকারী শিক্ষক বলেন, ‘আমরা সারা বছর পরিশ্রম করে যে বেতন পাই, রায়না তার কিছুই না করেও একই বেতন পাচ্ছেন। রায়না সরকারি চাকরি করে কর্মস্থলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার বিষয়টি গোপন করেছেন, আবার অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়েও চাকরির ব্যাপারটা গোপন করেছেন। তিনি একসঙ্গে দুটি অপরাধ করেছেন।’

রায়নার ফেসবুক প্রোফাইল চেক করে দেখা যায়, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার তথ্য সেখানে উল্লেখ করেছেন। তিনি ময়মনসিংহে বসবাস করছেন এবং সেখানে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর ছবি নিয়মিত আপডেটও করেন।

চাঁনপুর এলাকার একাধিক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, ‘আমরা শুধু জানি মেহবুবা রায়না নামে একজন শিক্ষিকা এই স্কুলে চাকরি করেন। তবে শুরুতে তাকে কয়েকদিন দেখেছি, পরে আর কোনোদিন স্কুলে আসতে দেখিনি। করোনা শুরুর আগে আবার কয়েকদিন স্কুলে আসতে দেখেছি। পরে আর দেখা যায়নি।’

চাঁনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী রায়নার নামও বলতে পারেনি। কারণ জানতে চাইলে সে বলে, ‘হেই ম্যাডাম পহেলা কয়েকদিন ইস্কুলে আইছে, পরে আর আইছে না। হের লাইগ্যে হেই ম্যাডামের নামটা মনে নাই।’

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ মফিজুল ইসলাম বলেন, ‘মেহবুবা রায়না বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকার কারণে ২০১৮ সালের ২০ নভেম্বর তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তার ইনক্রিমেন্ট স্থগিত করা হয়। পরে তাকে বিদ্যালয়ে যোগদানের অনুমতি দেয়া হয়।’

তিনি জানান, রায়না চাকরিতে যোগ দেয়ার পর তিনি বিভিন্ন মেয়াদে শুধু মেডিক্যাল ছুটি কাটিয়েছেন ২১৩ দিন। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর স্কুল খোলার পর ১২ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিনা অনুমতিতে অনুপস্থিত থাকার কারণে ২৩ সেপ্টেম্বর তার কৈফিয়ত তলব করা হয়। দায়িত্বে অবহেলার কারণে কেন তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তিন কার্যদিবসের মধ্যে সন্তোষজনক জবাব চাওয়া হয়।

এরপর উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম তালুকদার বিষয়টি তদন্ত করেন৷ তদন্ত প্রতিবেদনে তিনি জানান, রায়না ওয়ার্কশিট বিতরণ ও মূল্যায়ন এবং অভিভাকদের সঙ্গে যোগাযোগ সংক্রান্ত কোনো কাজেও অংশগ্রহণ করেননি৷ তাকে প্রধান শিক্ষক ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা জানালেও তিনি তাতে কর্ণপাত করেননি।

পরে রায়নার বেতন বন্ধ করতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করেন মফিজুল ইসলাম। আর গত ২৩ সেপ্টেম্বর মেহবুবা রায়নাকে শোকজ করা হয়। ২৭ সেপ্টেম্বর ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের মাধ্যমে এর জবাব দেন রায়না। কিন্তু জবাব সন্তোষজনক মনে না হওয়ায় রায়নার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে ফাইলটি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়।

এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আসাদুছ ছামাদ জানান, শিক্ষিকা রায়নার মেডিকেল ছুটি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার বিষয়টি তিনি জানলেও ডাক্তারের সার্টিফিকেট থাকায় কিছু করা যাচ্ছে না।

করিমগঞ্জের সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (এটিইও) রফিকুল ইসলাম জানান, শিক্ষিকা রায়না যোগদানের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ভালভাবে চাকরিটা করছেন না। তিনি কিছুদিন পর পরই মেডিকেল ছুটিতে চলে যান। ডাক্তার সার্টিফিকেট দিলে কিছুই করার থাকে না বলে তিনি মন্তব্য করেন। তবে তার অনিয়মিত থাকার বিষয়টি একাধিকবার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছেন বলে জানান তিনি। সবশেষ ২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের ১১ এপ্রিল পর্যন্ত মেডিকেল ছুটি কাটান রায়না। করোনাকালীন তিনি একবার এসে যোগদানও করেন। করোনাকালে ক্লাস বন্ধ থাকলেও ক্লাশের বাইরে কিছু কার্যক্রম চালু ছিল। কিন্তু রায়না সেটাতেও অংশগ্রহণ করেননি বলে জানান এটিইও। করোনার বন্ধের পর ১২ সেপ্টেম্বর বিদ্যালয় খোলা হলেও বিনা নোটিশে চারদিন অনুপস্থিত থাকেন রায়না। পরে গত ২৩ সেপ্টেম্বর এটিইও বিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়ে রায়নাকে না পেয়ে তার বেতন বন্ধসহ বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ করেন।

এর আগে ২০১৮ সালের ২০ নভেম্বর বিভাগীয় মামলার পরিপ্রেক্ষিতে রায়নার ইনক্রিমেন্ট স্থগিত করা হয়। এরপরও তাকে বিদ্যালয়ে ফেরানো যায়নি।

এ বিষয়ে কথা বলতে অভিযুক্ত শিক্ষিকা মেহবুবা রায়নার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। পরে মেসেজ দিয়েও তার সাড়া পাওয়া যায়নি। তার হোয়াটস অ্যাপ এবং ফেসবুক মেসেঞ্জারে একাধিকবার বার্তা পাঠানোর পর তিনি প্রতিবেদককে ব্লক করে দেন।

এ ব্যাপারে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সুব্রত কুমার বণিক জানান, ‘রায়নার ব্যাপারে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছ থেকে একটি অভিযোগ আমার অফিসে এসেছে। আমি এখন ছুটিতে আছি। অফিসে গিয়ে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’

তিনি বলেন, ‘রায়না যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্রী সেটি আমাদের অজানা ছিল। এ বিষয়েও খোঁজ নেয়া হবে।’

আরও খবর পড়ুন

Check out other tags:

পাঠকের পছন্দ

x